আমাদের দেশ ভারত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্রমশঃ উন্নতি করে চলেছে। বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নিত্যদিন নব্যনতুন অনুসন্ধান ও আবিষ্কার হচ্ছে। একদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি উৎসাহ বাড়ছে। মানুষকে মস্তিস্ককোষ থেকে অনেক অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কর সময়ের সঙ্গে দূর হয়ে চলেছে। কিন্তু এটি তো দেশের একাংশের চিত্র। কারণ আজও অনেক মানুষ ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, ভূত-প্রেত, ওঝা, তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, অলৌকিক ও কাল্পনিক গুলগল্পে এবং অন্ধবিশ্বাসে ডুবে রয়েছে। এই সব অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর প্রতারক অর্থাৎ ওঝা, তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, বাবাজী, মাতাজির মতন বুজরুকদের লোক ঠকানো ও বুজরুকি ব্যবসা ফুলেফেঁপে আছে। আজও অনেক বুজরুকরা অলৌকিক ক্ষমতা, ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদির সাহায্যে যে কোনও রোগের চিকিৎসা করার দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, তন্ত্রমন্ত্র, অলৌকিক উপায়ে যে কোনও রোগের চিকিৎসার দাবি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এর পরেও আজও এই পশ্চিমবঙ্গে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, হেঁকেডেকে রীতিমতো অলৌকিক স্বাস্থ্য শিবির খুলে বুজরুকি ব্যবসা চলছে। সাধারণ এবং গরীব লোকেদের অন্ধবিশ্বাস, দারিদ্র ও অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ফুলেফেঁপে চলেছে অলৌকিক ও বুজরুকি ব্যবসা। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সব কিছু জানা সত্ত্বেও পুলিশ ও প্রশাসন মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন।
অন্য দিকে আমরা যুক্তিবাদীরাই এই বুজরুকি ব্যবসা বন্ধের জন্য সব সময় সক্রিয়। যেখানেই বুজরুকি, সেখানেই যুক্তিবাদীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বুজরুকি মুখ থুবড়ে পড়ে। আজ এমনই একটি সত্যি ঘটনা লিখছি যা যুক্তিবাদী আন্দোলনকারীকে বুজরুকি ফাঁসের জন্য উৎসাহিত করবে।
মঙ্গলবার ১০ এপ্রিল ২০১২
গ্রামের মাঝে একটি খোলা মাঠ। বিচালির ছাউনি দেওয়া দু-একটি কুঁড়ে ঘর। আশে-পাশে কয়েকটি গাছ। তার ছায়ার নীচে ছয় থেকে ৬০ বয়সের ছেলে, মেয়ে, মহিলা, পুরুষ, বৃদ্ধা ও বৃদ্ধ বসে আছেন। এঁরা দূর-দূরান্ত থেকে এখানে এসেছেন নিজের জন্মান্ধ, মূক-বধির, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, থেকে মাথার যন্ত্রণা, যৌনরোগ, বাত, আলসার-সহ বিভিন্ন অসুখের চিকিৎসা করাতে। খোলা মাঠে গাছের ছায়ায় নিচে রীতিমতো স্বাস্থ্য শিবির চলছে। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন এই স্বাস্থ্য শিবিরে কোনও চিকিৎসক নেই। দু’জন সহকর্মীর সহায়তায় একজন ব্যক্তি তাঁর ‘অলৌকিক ক্ষমতা’র সাহায্যে শুধুমাত্র রুগীর কানে, মুখে, চোঁখে ‘ফুঁ’ দিয়ে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ‘হাত বুলিয়ে’ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করছেন। মধ্য বয়স্ক এই অলৌকিক চিকিৎসকের (?) নাম পঞ্চানন মাইতি। তিনি দাসপুরের গোসকপোতা গ্রামের নিবাসী। তাঁর দুই সহযোগী অরুণ গোস্বামী এবং সুকুমার সামন্ত। এঁরা রামদেবপুরের বাসিন্দা। প্রতি মঙ্গলবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার পালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় এই স্বাস্থ্য শিবির বসে। খোলা মাঠের এই শিবিরে এলেই প্রথমে প্রতিটি রুগীর পরিজনকে ১০ টাকায় বিনিময়ে একটা পুস্তিকা কিনতে হয়। পুস্তিকা বললে ভুল হবে কারণ এক টাকা দামের ছোট পাতলা খাতায় পেন দিয়ে কয়েকটি মন্ত্র লেখা থাকে। এর পর পঞ্চাননের দুই সহযোগী অরুন এবং সুকুমার মাঠে বসে থাকা প্রতিটি রুগীর কাছে গিয়ে তাঁর নাম, ঠিকানা, বয়স, রোগ ইত্যাদি একটি খাতায় লিখে রাখেন।
ফুলপ্যান্ট ও হাফ শার্ট পরিধানে পঞ্চানন মাইতি তাঁর এই শিবিরে চিকিৎসার জন্য আসা রুগীর এবং তাঁদের পরিজনদের উদ্দেশ্যে জোরে-জোরে বলতে শুরুর করেন, “আপনারা চিকিৎসার জন্য বড়-বড় হাসপাতালে ঘুরে-ঘুরে অনেক টাকা, পয়সা ও সময় নষ্ট করেছেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। শেষ আশার আলো দেখতে আজ আমার ‘অলৌকিক শিবিরে’ এসেছেন। কথা দিচ্ছি এখান থেকে কেউ নিরাশ হয়ে ফিরে যাবেন না। আমার ফুঁ ও হাতের স্পর্শ পেয়ে বোবা কথা বলে। জন্মান্ধ দু’চোখ খুলে জগৎ দেখে। কানে কালাও সব কথা শুনতে পায়। ল্যাংড়া, খোঁড়াও ঘোড়ার মতন দৌড়তে শুরু করে। যে যেখান বসে আছেন, সেখানেই একটু ধৈর্য ধরে বসুন। আমি নিজেই আপনাদের কাছে এসে রোগমুক্তি করব। কেউ নিরাশ হয়ে ফিরবেন না। অবশ্যই ফল পাবেন।”
রোগীদের কাছে বিক্রি করা একটি পুস্তিকা নিজের হাতে নিয়ে পঞ্চানন বললেন, “এই পুস্তিকাতে রোগ মারণ মন্ত্রের শ্লোক লেখা আছে। আমি এই শ্লোকগুলি পাঠ করছি। আমরা সঙ্গে-সঙ্গে আপনারাও সব্বাই একসাথে শ্লোকগুলো পাঠ করুন।”
এরপর পঞ্চানন সহ অন্যান্য লোকেরা একযোগে মন্ত্র ও শ্লোক পাঠ করলেন। সব্বাইকে থামিয়ে দিয়ে রুগীদের অলৌকিক চিকিৎসা শুরু করলেন পঞ্চানন বাবাজী। দূর গ্রাম থেকে নিজের মা-বাবার সঙ্গে এসেছে এক নাবালিকা। সে জন্ম থেকেই বোবা। মেয়ে যদি কথা বলতে পারে এই আশা নিয়ে এসেছেন তাঁরা। পঞ্চানন বাবাজী বোবা মেয়ের কাছে গেলেন। তার মায়ের দিকে তাকিয়ে পঞ্চানন বাবাজী বললেন, “চিন্তা করিস না মা। আমার চিকিৎসায় তোর মেয়ে কথা বলবে। মুখে কথার ফুলঝুরি ফুটবে।”
নাবালিকার মাথায় হাত রেখে পঞ্চানন বাবাজী বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন এবং দু-তিনবার ফুঁ দিলেন। মাথার পর শরীরের বিভিন্ন স্থান হাত বুলিয়ে ফুঁ দিতে লাগলেন। পঞ্চানন বাবাজী অশ্লীল ভাবে গায়ে হাত বোলাচ্ছিল তাতে মেয়েটি অসস্তি বোধ করে। এরপর বাবাজী মেয়েকে মুখ হাঁ করতে বলেন। বোবা মুখ হাঁ করলো। পঞ্চানন বাবাজী তার মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে জিভ ধরে টেনে ধরলেন। নিজের জিভ নাবালিকার জিভে স্পর্শ করলেন। কিছুক্ষন পরে ওর মুখে দু’বার ফুঁ দিয়ে পঞ্চানন বাবাজী আদেশের সুরে বললেন, “বলো মা। বলো বাবা, আব্বা। কিরে বলছিস না কেন? আমার দিকে তাকিয়ে বলো, মা বাবা, আব্বা।”
বেচারি বোবা মেয়েটি চিকিৎসার নামে পাঞ্চনন বাবাজির অশ্লীল আচরণে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছে। জন্ম থেকে বোবা মেয়েটি হয়তো কিছু বলার জন্য দু-দু বার মুখ হাঁ করলো। কিন্তু মুখ দিয়ে একটি শব্দ বেরোলো না। সে ফ্যাল-ফ্যাল দৃষ্টিতে বোবার মত তাকিয়ে রইল এবং তার দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে পঞ্চানন বাবাজী বললেন, “দুঃখ করিস না খুকি। তুই কথা কইবি। আমার গুরুর আশীর্বাদে তোর মুখে কথা ফুঁটবে।”
নাবালিকার মাকে বাবজিকে বললেন, “তোর মাইয়া কথা কইবে। ওকে আগামী মঙ্গলবার আবার এই শিবির নিয়ে আসবি। আরও তিন বার চিকিৎসা করতে হবে ওকে। তারপর মাইয়ার মুখে বুলি আসবে। দেখবি বোবা মামা, বাবা, আব্বা বলে বলে ডাকবে।” কিছু দূরে একটি গাছের নিচে এক মহিলা তার অন্ধ ছেলেকে নিয়ে বসে আছেন। পঞ্চানন বাবাজী তাঁদের কাছে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “এই ছেলে কবে থেকে চোখে দেখতে পায় না?”
মহিলা বললেন, “জন্মান্ধ।”
“চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমার কাছে এসেছি। এ ছেলে আমার হাতের স্পর্শে দু’চোখ খুলে সব দেখবেই।” বাবাজী বলেন।
অন্ধ ছেলের দু’চোখে নিজের দু’হাতের বৃষ্ঠাঙ্গুল চেঁপে ধরলেন। আঙ্গুল সরিয়ে দু-বার ফুঁ দিলেন। এবং বাবাজী বললেন, “খোকা চোখ খুলে দেখ। তোর সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে।”
ছেলেটি দু’হাত বাড়িয়ে এদিক ওদিক মাথা ঘোরাতে লাগল। না ও কিছুই দেখতে পারছে না।
এই দেখে পঞ্চানন বাবাজী বললেন, “খোকা জন্ম থেকে অন্ধ। তাই তোর চোখে আলো ফিরতে একটু সময় লাগবে। আমার কাছে আরও কয়েকবার আসবি। আমার মন্ত্র শক্তিতে তুই দু’চোখ ভরে দুনিয়া দেখবি।”
এক যুবতী। কানে কালা। ছোটো বেলায় শুনতে পেত। কিন্তু একটি দুর্ঘটনায় মাথায় চোট পাবার পর থেকে সে শুনতে পায় না। সে তাঁর মায়ের সঙ্গে এসেছে এই অলৌকিক চিকিৎসা শিবিরে।
যুবতীর মাথায় হাত রেখে পঞ্চানন বাবাজী মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলেন। এরপর দু’হাতে তাঁর দু’কান ধরে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে দু’কান দু-দু বার ফুঁ দিলেন। ঝাড়ফুঁক করার পর বাবাজী জিজ্ঞেস করলেন, “মাইয়া তোর নাম কি?”
মেয়েটি চুপ করে তাকিয়ে রইল। পাশে বসে মা বললেন, “মনে হচ্ছে মেয়ে এখনো শুনতে পাচ্ছে না।”
একটু জোরে আবার পঞ্চানন বাবাজী জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কি তোর?” না। মেয়ে কিছুই শুনতে পাইনি। এবং সে বললো, “আমি কোনো কথা শুনতে পারছি না।”
পঞ্চাননের সহযোগী একটি ছোট্ট শিশি মেয়ের মায়ের হাতে দিয়ে বলল, “এতে মন্ত্রপুত জল আছে। রোজ সকালে দু’ফোঁটা করে কানে দিবে। কানে শুনতে পাবে। আগামী মঙ্গলবার মেয়েকে আবার নিয়ে আসবি পঞ্চানন বাবাজীর কাছে।”
এই ভাবে জন্মান্ধ, মূক-বধির, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, থেকে মাথার যন্ত্রণা, যৌনরোগ, বাত, আলসার-সহ যে কোনও রোগগ্রস্তের অলৌকিক চিকিৎসা চলতে লাগলো। মাঝে-মাঝে পঞ্চাননের দুই সহযোগী অরুন ও সুকুমার মাঠে অলৌকিক চিকিৎসা শিবিরে আগত রুগীদের এবং তাঁদের পরিজনদের এই কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, “আজ যারা পঞ্চানন বাবাজীর এই অলৌকিক শিবিরে দূর-দূরান্ত থেকে আরোগ্য লাভের আশায় এসেছেন। কেই বাবাজির কৃপা থেকে বঞ্চিত হবেন না। সবার উপর বাবাজীর আশীর্বাদ সূর্য্যের আলোর মত ঝরে পড়বে। বাবার আশীর্বাদে নিজেকে ধন্য করতে দু’হাতে দান বাক্সে দান করতে ভুলবেন না। যে যত বেশি টাকা পয়সা দান করবেন, বাবাজীর কৃপা ও আশীর্বাদ তাঁদের পরিবারের উপর তত বেশি করে ঝরে পড়বে। একশো, হাজার যার যেমন ইচ্ছা দান করুন।”
প্রতি মঙ্গলবার এই অলৌকিক চিকিৎসা শিবির খোলা মাঠে চলে। রোগী এলেই প্রথমে তাকে ১০ টাকার বিনিময়ে একটা পুস্তিকা কিনতে হয়। পরে একটি বাক্সে রোগীকে ইচ্ছে মতো টাকা দিতে বলা হয়। এ ভাবে প্রতি মঙ্গলবার ৮-১০ হাজার টাকা রোজগার হচ্ছে। ইতিমধ্যে পঞ্চানন বাবাজীর এই অলৌকিক শিবিরে এসে অনেক রোগীর মাথা ব্যাথা, হাটু, কোমর, গাঁটে ব্যাথা, অনিদ্রা ইত্যাদি দূর হয়ে গেছে। আমরা লেখা এইটুকু অংশ পড়ার পর হয়তো কেউ ভাবতে পারেন, “সত্যিই কি এভাবে খেলা মাঠের মাঝে পঞ্চানন বাবাজী তাঁর দুই সহযোগী অরুন এবং সুকুমারের সাহায্যে নিয়ে শুধুমাত্র কানে ফুঁ দিয়ে, মাথায়, শরীরের বিভিন্ন স্থানে হাত বুলিয়ে নানা রোগ সারানোর কারবার ফেঁদেছেন?”
হ্যাঁ। সত্যিই। শুধুমাত্র ফুঁ দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে নানা রোগ সারানোর কারবার ফেঁদেছেন এই তিন প্রতারক। জন্মান্ধ, মূক-বধির, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, থেকে মাথার যন্ত্রণা, যৌনরোগ, বাত, আলসার-সহ যে কোনও অসুখ সারিয়ে দেওয়ার দাবি করছেন এই তিন প্রতারক। প্রকাশ্যে এই প্রতারণা চলছে। কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন? এই প্রশ্ন নিয়ে ‘ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখার কর্মকর্তা দেবব্রত আমাকে ফোন করলো এবং বললো, “সন্তোষ দা, তুমি সাংবাদিক। এই অলৌকিক চিকিৎসা শিবির এবং পঞ্চানন বাবাজীর বুজরুকি বন্ধ করতে সংবাদ মাধ্যমের সাহায্য প্রয়োজন।”
আমি বললাম, “তুই জানিস আমিও যুক্তিবাদী সমিতি’র সংযুক্ত সম্পাদক। তাই জন্মান্ধ, মূক-বধির, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, থেকে মাথার যন্ত্রণা, যৌনরোগ, বাত, আলসার-সহ যে কোনও অসুখ সারিয়ে দেওয়ার দাবি করা এই পঞ্চানন বাবাজী এবং তাঁর বুজরুকি শিবিরের বিরুদ্ধে সব রকম পদক্ষেপ নিতে আমিও তৈরি আছি। কিন্তু এর জন্য সবার আগে প্রমাণ জোগাড় করে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হবে।”
“কিসের প্রমাণ?” দেবব্রত জিজ্ঞেস করল।
আমি বললাম, “এই বুজরুকি বন্ধের জন্য অভিযোগ করার আগে প্রমাণ লাগবে। পুলিশের কাছে মুখে বললে হবে না। একটা কাজ কর। তুই পঞ্চানন বাবাজীর অলৌকিক শিবিরে একজন রুগী সেজে চলে যা। পারলে তোকে যখন ফুঁ, স্পর্শ ইত্যাদি করে চিকিৎসা করবে, সেই সময় তোর কোনও বন্ধুকে বলে গোপনে ছবি তুলে নিবি। এর পর তুই নিজে একজন রুগি হিসাবে থানাতে ওই প্রমাণ ছবি সহ অভিযোগ দায়ের করবি। বাকি আমি সাংবাদিক হিসাবে বুজরুকি বন্ধের জন্য পুলিশের সঙ্গে কথা কথা বলব।”
আমরা কথা শুনেই দেবব্রত ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “রুগি সেজে গেলে যদি পঞ্চাননের লোকেরা ধরে ফেলে তাহলে বিপদ হতে পারে।”
আমি বললাম, “তুই কেন বিপদে পড়বি? যারা বুজরুকি ব্যবসা করছে তাঁরা বিপদে পড়বে। তোর দ্বারা যদি এইটুকু না হয় তাহলে ছেড়ে দে। কিছু করতে হবে না।”
“ঠিক আছে যাচ্ছি।” কয়েক ঘন্টা পরে খবর পেলাম যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখা থেকে কয়েকজন সদস্য দাসপুরের গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় গিয়ে গোটা ঘটনা গোপনে ভিডিও ক্যামেরাবন্দি এবং ছবি তোলা। এই খবর পাওয়ার পর আমি দেব্রতকে ফোন করে বললাম, “তুই আজই এই প্রমাণের ভিত্তিতে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনকে যুক্তিবাদী সমিতি’র প্যাডে লিখিত অভিযোগ দায়ের কর এবং ওই চিঠি আমার কলকাতার পত্রিকা অফিস ‘ দৈনিক বিশ্বমিত্র’-এ ইমেল বা ফ্যাক্স করে পাঠা।” চিঠিতে কি কি লিখতে হবে সেই বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে দিলাম। যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখার তরফ থেকে ঘাটাল মহকুমা শাসককে গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় পঞ্চানন মাইতির বুজরুকির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে চিঠি পাঠান হয়। নিচে পুরো চিঠিটি তুলে দিলাম।
প্রতি ১০/৪/২০১২
মাননীয়
মহকমা শাসক মহাশয়
ঘাটাল
মহাশয়,
“...আমরা ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখার পক্ষ থেকে আপনার কাছে একটি দাবি রাখতে চাই। আমরা দেখলাম গোপালপুর গ্রাম (জানাপাড়া, গ্রাম গোপালপুর, থানা- দাসপুর, জেলা- প: মেদিনীপুর ) -এ ‘ ফুঁ’ দিয়ে রোগ সরানোর’ নামে একটি অবৈজ্ঞানিক, বেআইনি এবং প্রতারণা মূলক ব্যবসা গত দ’সপ্তাহ ধরে চলে এসেছে। ‘ ড্রাগ এন্ড কমমেটিকস অ্যাক্ট,১৯৪০ অনুসারে এই ধরনের ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে বে-আইনি এবং উক্ত প্রতারক ও এরূপ প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিগণ দোষী বলে অভিযুক্ত হবে এবং তদানুসারে দণ্ডপ্রাপ্ত হবে। এরুপ প্রতারকদের থেকে সমাজকে বাচাঁতে আপনার কাছে আমাদের দাবি মানুষের অজ্ঞাতাকে নিয়ে এই বে-আইনি ব্যবসাটির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিন। আমরা ‘ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছি।”
ধন্যবাদ
দেবব্রত
এই চিঠি পাঠানোর পর দেব্রত জানাল সে আগামী কাল কলকাতায় আসছে। আমার সঙ্গে দেখা করবে। ভালো কথা।
বুধবার ১১ এপ্রিল ২০১২
অলৌকিক চিকিৎসার নামে পঞ্চানন বাবাজী জন্মান্ধ, মূক-বধির, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে শুধু প্রতারণাই নয়, তাঁদের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করছে। এই পতারককে জেলে পাঠান উচিৎ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যুক্তিবাদী সমিতি’র অভিযোগের পরেও পুলিশ অভিযুক্ত পঞ্চানন বাবাজী এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ নেয়নি। এই দেখে সন্দেহ হতেই পারে গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় বুজরুকি ব্যবসায় পুলিশের অপ্রত্ক্ষ সহযোগিতা থাকতে পারে। কারণ, দিনের আলোতে, খোলা মাঠে অলৌকিক শিবির দিনের পরদিন চলছে। কিন্তু অভিযোগ পাওয়ার পরও পুলিস চুপ মেরে কেন আছে? এই গন্ধটা সন্দেহজনক!
বিকেলে দেব্রত তার স্ত্রীরির সঙ্গে কলকাতার তালতলায় আমার পত্রিকা ‘ দৈনিক বিশ্বমিত্র’ -এর অফিসে এলো। ঘাটালের গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় পঞ্চানন বাবাজীর অলৌকিক শিবির নিয়ে অনেকে কথা হল। আমি নিজের নোটপ্যাডে জরুরী তথ্য লিখে রাখলাম। এবং বললাম, “আমি কালকেই বলেছিলাম তুই রুগী সেজে পঞ্চাননের শিবিরে যা। তারপর নিজে একজন রুগী হিসাবে অভিযোগ দায়ের কর। কিন্তু তুইতো আমার কথায় কান দিলি না।”
সে বলল, “বিপদ হতে পারে ভেবে রুগী সেজে ওখানে গেলাম না।”
“কেন? কিসের বিপদ?” জিজ্ঞেস করলাম।
সে বলল, “তোমার কথা মত যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখা থেকে আমি, সুরজিৎ, মানস ও সঞ্জয় চারজনে গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় পঞ্চানন বাবাজীর অলৌকিক শিবিরে যাই। গিয়ে দেখি, সম্পূর্ণভাবে অবৈজ্ঞানিক ও বে-আইনিভাবে ফুঁ দিয়ে, রুগীরদের শরীরে অশ্লীলভাবে হাত বুলিয়ে চিকিৎসার নামে দিন-দুপুরে বুজরুকি ব্যবসা চলছে। প্রতারণার এই ব্যবসায় শুধুমাত্র পঞ্চানন এবং তাঁর দুই সহযোগীই নয়, আরও অনেক সমাজবিরোধীরাও যুক্ত আছেন। এই অবস্থায় আমরা যদি পঞ্চাননের বুজরুকি ব্যবসার সরাসরি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি তাহলে বিপদ হতে পারে। পঞ্চাননের লোকেরা আমাদের উপর হামলা করতে পারে। তাই আমরা তোমার কথা মত শুধু গোপনে কিছু ছবি তুলতে পেরেছি। যদি আমার কাছে প্রেস কার্ড থাকতো তাহলে পঞ্চাননকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বুজরুকি ফাঁস করে দিতাম। আমার জন্য একটি প্রেস কার্ডের বানিয়ে দাও।”
আমি বললাম, “রুগী সেজে পঞ্চানন বাবাজীর কাছে যেতে তোর ভয় করছে। বিপদ হতে পারে। তাহলে প্রেস কার্ড নিয়ে তাকে কোন সাহসে চ্যালেঞ্জ জানাবি? প্রেস কার্ড পাওয়া এত সহজ কথা নয়। তুই যদি ঠিক মতন কাজ করিস, মিডিয়ার খবরে তোর নাম উঠে আসবে। এবং আমি তো তোর সাংবাদিক বন্ধু। ভেবে বল, পঞ্চানন বাবজীকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার করার জন্য কী কী করতে হবে?”
না। ও কোনও উত্তর দিতে পারলো না। ভেবেছিল আমার কাছ থেকে প্রেস কার্ড পাওয়া যাবে। কিন্তু না শুনে ওর ভালো লাগেনি। তাই হতাশ হয়ে ফিরে গেল। এরপর পত্রিকা অফিসে থেকে যুক্তিবাদী সমিতি’র সভাপতি প্রবীর ঘোষকে ফোন করে সব কথা বলল। শুনেই প্রবীর বাবু রেগে গিয়ে বললেন, “ও একটা কাজ দিতে ঠিক মতন করতে পারে না। আবার প্রেস কার্ড নিয়ে ওকি ঘোড়ার ডিম করবে? তুমি ওর সম্পর্কে আমাকে কিছু বললে না। একটি প্লান বানিয়ে ওকে বোঝাও কি করে পঞ্চাননকে জালে ফাঁসান যায়। কারণ তুমিও যুক্তিবাদী সমিতি’র একজন পদাধিকারী। তুমিও আমার সঙ্গে অনেক অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের বুজরুকি ফাঁস করছো। আমি দেখতে চাই তোমার নেতৃত্বে পঞ্চানন বাবাজীর অলৌকিক শিবিরের বুজরুকি ফাঁস হোক। সংবাদ মাধ্যমের শক্তি প্রয়োগ করে এই অভিযুক্ত প্রতারকদের পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করে দেখাও।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে। প্লান বানিয়ে কাজ শুরু করছি। গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় পঞ্চানন বাবাজীর অলৌকিক শিবির নিয়ে যে তথ্য ও অভিযোগ পেয়েছি তার ভিত্তিতে একটি খবর আমার পত্রিকায় লিখে দিচ্ছি। তার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তা করব।”
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় দাসপুরের গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় অলৌকিক শিবিরে ফুঁ দিয়ে, স্পর্শ করে রোগের চিকিৎসা নামে বুজরুকি চলছে। অন্যদিকে, খড়গপুরের বাঁশপতির গ্রামে যুগল মাহাত নামক এক বাবাজী নিজের মাথার ঘাম দিয়ে যে কোনও অসাধ্য রোগের চিকিৎসা করে রুগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছে। কিন্তু এই প্রতারকের বিরুদ্ধে পুলিশ বা প্রশাসন কোনও ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি।
শুক্রবার ১৩ এপ্রিল ২০১২
আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় কোথায় বা ফুঁ দিয়ে তো কোথাও মাথার ঘাম দিয়ে বুজরুজি চিকিৎসা চলছে। এই বুজরুকদের খপ্পড়ে পরে অনেক অসহায় রুগী ও মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। কিন্তু জানিনা কোন সম্মোহনে পুলিশ ও প্রশাসন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে? কিন্তু আমরা সাংবাদিক কলম দিয়ে আঘাত করে এঁদের ঘুম ভাঙাতে চেষ্টা করে চলেছি। তাই আজ আমার পত্রিকা ‘ দৈনিক বিশ্বমিত্র ’-তে গোপালপুর গ্রামে পঞ্চানন বাবাজীর ফুঁ দিয়ে এবং খড়গপুরে যুগল মহাতোর মাথার ঘাম দিয়ে বুজরুকি চিকিৎসার খবর চার কলম জুড়ে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। ‘ কোথাও বা ফুঁ দিয়ে তো কোথাও মাথার ঘাম দিয়ে চিকিৎসার ব্যবসা ’ এই শিরোনামে আমার লেখা খবর প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকের সামনে এই খবরের একাংশ তুলে ধরছি।
পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৩ এপ্রিল (নি.প্ৰ.)। আজ এই বাংলা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক বিকশিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিষয়ে নিত্যদিন নতুন-নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। রাজ্য বাসীদের মধ্যে যেমন বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহ বাড়ছে, সেখানে অনেক অন্ধবিশ্বাস জনগনের মন-মস্তিস্ক থেকে দূর হয়ে চলেছে। এটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশের ছবি। অন্য অংশের ছবিটি হল, আজও অনেক মানুষ ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, ভূত-পেত্নি, ওঝা- তান্ত্রিক, অলৌকিক, গুলগল্পে বিশ্বাস করেন। এবং এই সবের সুযোগ নিয়ে এই বাংলায় ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, ওঝা-তান্ত্রিকের বুজরুজি ব্যবসা ফুলেফেঁপে রয়েছে। আজও তথাকথিত ওঝা, তান্ত্রিক, বাবাজী-মাতাজী ঝাড়ফুঁক করে যে কোনও রোগের চিকিৎসা করার দাবি জানাচ্ছেন। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে বিভিন্ন স্থানে ফুঁ বা মাথার ঘাম দিয়ে বুজরুজি চিকিৎসা চলছে।